স্নাতকোত্তর পেরিয়ে ক্যারিয়ার আর জীবন গোছানোয় মন দিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের সাবেক শিক্ষার্থী তনিমা আফরিন তূর্ণা। চাকরি করবেন নিশ্চিত, জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দিতে পাশে নেবেন একজন সঙ্গীও। তূর্ণা চান, তার সঙ্গী তাকে চাকরি করতে বাধা দেবে না, ঘর সামলানোর কথা বলে আটকে দেবে না।
তূর্ণার ভাষায়, “জন্মলগ্ন থেকেই সমাজ আমাদের শেখায় ঘর সামলানোটা মেয়েদের দায়িত্ব। এই সময়ে এসেও সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অনেক মানুষ মনে করে, ঘরের কাজে ছেলেরা হাত দেওয়াটা লজ্জার, ঘরের কাজ করলে তাদের মূল্যায়ন কমে যাবে। আমি আশপাশে তাকালেই অনেক দম্পতি দেখি, যেখানে পুরুষ সঙ্গীটি অনেক বেশি স্বৈরাচারী। তখন আশঙ্কা জাগে আমার জীবনেও এমন কেউ আসতে পারে। আশা জাগে, আবার শঙ্কাও থেকে যায়।”
যে শঙ্কা তূর্ণার, তাকে সঙ্গী করেই জীবনের ৮০ বছর পাড়ি দিয়ে এখন শারীরিক সামর্থ্য হারিয়েছেন নেত্রকোণার আয়েশা বেগম। ১৬ বছর বয়সে সংসার শুরুর পর থেকে তাকে আজীবনই তটস্থ থাকতে হয়েছে কৃষক স্বামী মাঠ থেকে ফেরার পর যেন তার গোসলের লুঙ্গি-গামছা আর গরম খাবার প্রস্তুত থাকে তা নিয়ে। তবে এর সঙ্গে তাকে সারতে হয়েছে বাড়ির সব কাজও।
কাঁপা কাঁপা স্বরে আয়েশা বেগম বলেন, “মাইয়া মানুষ বাড়িত থাকবো, ঘরের কামকাইজ করবো, এইডাই তো রীতি। ব্যাডা মানুষ খেত-খামার, হাট-বাজার যাইবো। বউ তার দেখভাল করবো। এই হালেই তো দিন কাডাইলাম।”
আয়েশা বেগমের দিন স্বামীর দেখভাল করে কাটলেও দিন যত গড়িয়েছে, নারী-পুরুষের কাজের ধারায় পরিবর্তন এসেছে। অনেক নারীই এখন বাইরে কাজ করছেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানো কিংবা পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন অনেক নারী। ফলে, পরিবর্তন আসছে ঘরের কাজের দায়িত্বের চিরায়ত লৈঙ্গিক বিভাজনেও।
নারায়ণগঞ্জের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান এক সন্তানের মা সাবিকুন নাহার মনি। মিরপুরের বাসিন্দা মনিকে খুব সকালেই স্কুলের বাস ধরতে হয়। ঘরের কাজগুলো তাই তিনি আর তার স্বামী ভাগ করে নিয়েছেন। ফলে, বাইরে নিজের কাজগুলো ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারছেন মনি।
এই নারী বলেন, “পরিবার চাইলে একটা নারী বাইরে কাজ, সংসার দুটোই করতে পারবে। আমি আর আমার স্বামী দুজন মিলে ঘরের দায়িত্বগুলো ভাগ করে নিয়েছি, এতে আমাদের চাকরি এবং ঘর সামলানো সহজ হয়েছে। আমি বাইরে কাজ করতে পারার কারণে আমাদের পরিবার অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছে। এটি কিন্তু আবার আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও যোগ হচ্ছে। ফলে, নারীর কাজ করতে পারা আর ঘরের কাজ শুধু নারীর কাঁধে না দিয়ে দেওয়ার একটা বৃহৎ জাতীয় উপকারও কিন্তু আছে।”
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অনেক নারী এলেও কর্মজীবী নারীদের ঘরের কাজের চাপ এখনও কমেনি; যদিও গৃহস্থালি কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখনও নেই বাংলাদেশে। জিডিপিতে গৃহশ্রম যোগ না হওয়ায় নারীদের এই অবদান উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
ঘরের কাজ আসলে কার?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২১ সালের এক জরিপ বলছে, গৃহস্থালি কাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় আট গুণ বেশি সময় ব্যয় করে।
গত বছরের জুনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন বলছে, পুরুষেরা যেখানে দিনের ১ দশমিক ৬ ঘণ্টা ঘরের কাজে ব্যয় করে, সেখানে নারীরা প্রায় ১১ দশমিক ৭ ঘণ্টা ঘরের কাজ করে, যা দিনের প্রায় অর্ধেক। এই কাজগুলোর কোনো মূল্যমান নারী পায় না। ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত নারীদের এসব অবৈতনিক গৃহস্থালী কাজ বাড়তেই থাকে, ৬০ বছরে পা দিলে ধীরে ধীরে তা কমতে শুরু করে। বিয়ের পর নারীদের এসব কাজে আরও বেশি সময় দিতে হয় বলেও উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।
ঘরের কাজের ক্ষেত্রে এই চিত্রের পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহবুবুল হক ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, “ঘরের কাজ শুধু নারীর হওয়া উচিৎ না। ঘরের কাজ আমার কাছে সবসময় একটা মৌলিক বিষয়, যা সবারই পারা ও করা উচিৎ। কিন্তু আমাদের সমাজে ঘরের কাজের একটা লৈঙ্গিক বিভাজন আছে। এটা থাকা উচিৎ না।”
এক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন যে আসছে, তা দেখা যায় ব্যাংকার দম্পতি আফসারা হোসাইন ও মশিউর রহমান প্লাবনের সংসারে তাকালে। নিজেদের এক ছেলে ও এক মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই তারা নিজের কাজটি নিজে করার শিক্ষা দিয়ে বড় করার চেষ্টা করছেন।
আফসানা বলেন, “আমার ছেলের বয়স ১০ বছর। আমি যদি এখন থেকেই আমার ছেলেকে শেখাই, তোমার প্লেটটা ধুয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার, জামাটা আলমারিতে তোমাকেই তুলে রাখতে হবে, তোমার বোন বা আমার দায়িত্ব এটি নয়, তাহলে সে কিন্তু শিখবে ঘরে নিজের কাজটা নিজের করা উচিৎ।
“ছোটবেলা থেকে না শিখলে সে বড় হয়ে তার আশপাশের নারী সদস্যটির উপর এসব কাজ চাপিয়ে দেবে, এটাকে স্বাভাবিক মনে করবে।”
মশিউর বলেন, “নারীর উপর ঘরের কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা আমরা ঘর থেকেই শিখি। আমি ও আমার স্ত্রী দুজনই ব্যাংকার, দুজনেরই কাজ আছে। এখানে আমি যেমন কাজ করি, সেও করে। ঘরের সব কাজের বোঝা যদি আমি তার ঘাড়ে দিই, তাহলে সেটা অন্যায় হবে।
“আমরা কাজ ভাগ করে নিয়েছি। ছেলে-মেয়েদের দায়িত্বও ভাগ করে দিয়েছি। তবে এসব কাজ ভাগের ক্ষেত্রে আবার ছেলে-মেয়ে নির্দিষ্টকরণ করিনি। আমার ছেলে তো প্রায়ই রান্নাঘরে আসে, আলু-পেঁয়াজ কাটে, মেয়ে আমার সাথে বাজারে যায়, অসুবিধা কোথায়?”
সম্প্রতি দাম্পত্য জীবন শুরু করা একটি এমপিওভুক্ত কলেজের প্রভাষক নীলা জামান বলেন, “নারী-পুরুষ দুইয়ে মিলেই যেহেতু সংসার তাই সংসার দায়িত্ব-কর্তব্য উভয়ে মিলেমিশে পালন করলেই সংসার সুন্দর হয়। এক দিকে ভার হেলে পড়লে যেমন ভারসাম্য নষ্ট হয়, তেমনি সংসারেও কোনো এক পক্ষের প্রতি কোনো এক কাজ চাপিয়ে দিলে শান্তি-আনন্দ বিঘ্নিত হয়। তাই সুন্দর, সুস্থ এবং আনন্দময় সম্পর্ক বজায় রাখতে নারী-পুরুষ উভয়েরই ঘরের কাজে সমান অংশগ্রহণ করা উচিৎ।”
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুবুল হক বলেন, “আমাদের সমাজে এখন মেয়েদের চাকরি করার প্রবণতা বেড়েছে, সে বাইরেও কাজ করে আবার ফিরে রান্নাঘরেও যেতে হয়। কিন্তু ছেলেরা সোফায় বসে থাকে। সমাজকে এসব জায়গা থেকে বের হতে হবে।”
পরিবার থেকেই একাজটি শুরুর উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি তিনি বলেন, “আমাদের দেশেও শিক্ষাব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।”
ঘরের কাজের এই লৈঙ্গিক বিভাজন দূর করতে কাছাকাছি পরামর্শ দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেনেন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক।
তিনি বলেন, “পরিবারের মধ্য থেকে পরিবর্তন আসতে হবে। মা-বাবাকে ছেলে-মেয়েকে শেখাতে হবে এটা ঘরের কাজ, তা সবার শিখতে-জানতে হবে। এতে সমাজে পরিবর্তন আসবে।
“আর দ্বিতীয় ধাপে রাষ্ট্রকে তার ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা হতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনা খুব ছোটবেলা থেকে ছেলে-মেয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য শেখানোর ব্যবস্থা রাখা।”
ঘরের কাজের বণ্টনে কাঠামোগত উদ্যোগ
কর্মজীবী দম্পতিদের মধ্যে ঘরের কাজে নারী-পুরুষ উভয়ের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বাড়লেও কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের সমাজে নারীর ঘরের শ্রমের সঙ্গে কৃষিপণ্যের সঙ্গে জড়িত শ্রমের মূল্যায়নও হয় না।
নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক বলেন, “নারী শুধু কৃষিই না, অন্য অনেক খাতে ঘরে-উঠোনে অনেক কাজ করে, যার একটা আর্থিক মূল্য আছে, কিন্তু নারী সেটা পায় না।
“আমাদের দেশে কিছু জেলায় নারীরা ধান বুনলেও বেশিরভাগ জেলায় নারীদের ধানের কাজ শুরু হয় ধানটা যখন তার উঠোনে এসে পৌঁছায় তারপর থেকে।
“মাড়াই করা, বাছা, গোলায় ভরা, বীজের ধানটা আলাদা করার কাজও নারী করে, এটার অর্থনৈতিক মূল্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কিন্তু কেউ স্বীকারও করে না। কৃষক নারী বলে চেঁচামেচি আমরা যতই করি, কৃষক শব্দটা শুধু পুরুষদেরই রয়ে গেল।”
সেই চিত্র বদলানোর এক চেষ্টা ‘জেন্ডার-রেস্পন্সিভ কোস্টাল এডাপটেশন (জিসিএ)’ প্রকল্প। উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবনে বিশেষ করে নারীদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবলোয় তাদের ‘চেঞ্জ এজেন্ট’ হিসেবে তৈরি করতে ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’র অর্থায়ন ও বাংলাদেশ সরকারের সহ-অর্থায়ন এবং ইউএনডিপির কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পটি চলছে, যার অধীনে ঘরের কাজের অদল-বদল স্লোগানের মাধ্যমে খুলনা ও সাতক্ষীরার ৩৯টি ইউনিয়নের ১০১ ওয়ার্ডে একটি করে পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়ির পুরুষদের নারীদের কাজে সহযোগিত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
এসব আলোচনায় থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর মতামতের মূল্যায়ন, পরিবারের খাওয়ার ও রান্নার পানি মিলেমিশে সংগ্রহ করা, সমাজ ও পরিবারে নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় করণীয়সহ নানাবিধ বিষয়।
খুলনার দাকোপ থানার তলিডাংগা ইউনিয়নের সত্যপীর গ্রামের নারী শান্তি রানী মন্ডলের অভাবের সংসার স্বামীর একক আয়ে ভালো যাচ্ছিল না। জিসিএ প্রকল্পের অধীনে এক উঠান বৈঠকে শান্তি রানীর স্বামী-ছেলেকে বোঝানো হয়, ঘরের কাজে মাকে সাহায্য করলে মা কিছু সবজি বুনতে পারবেন, যা তাদের সংসারেরই আয় বাড়াবে।
এরপর থেকে পানি আনা, সবজি বাগানের চারপাশ রক্ষা করা, হাঁস-মুরগির খাবার দেওয়া, রান্নার কাজে সাহায্য করায় অংশ নেয় শান্তি রানীর স্বামী ও ছেলে। শান্তি রানীর স্বামী প্রভাষ মন্ডল বলেন, “সংসার এখন অনেক সুখে ও আগের চেয়ে স্বচ্ছন্দে চলছে। সব কাজ স্বামী-স্ত্রী ও ছেলে ভাগাভাগি করে নেওয়ায় অনেক শান্তিতে বসবাস করছি।”
একই প্রকল্পের উপকারভোগী পানখালী ইউনিয়নের মৌখালী গ্রামের সাবিত্রী বাছারকে সংসার টানতে দিনমজুর স্বামী বিনয় কৃষ্ণ বাছারের মতো অন্যের জমিতে কাজ করতে হত। জিসিএ প্রকল্পের অধীনে স্বামী বিনয় বাছাড় এখন তাকে ঘরের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন।
বিনয় কৃষ্ণ বলেন, “আমি আগে পরিবারের কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করতাম না। এখন বুঝেছি, ঘরে স্ত্রীদের কত কাজ করতে হয়, সে এখন একটু বেশি বিশ্রাম পায়। পরিবারে এখন শান্তি বেড়েছে। এটা আগে শুরু করলে ভালো হত।”
জিসিএ প্রকল্পের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেশন স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ ইফতেখার হোসেন বলেন, “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পুরুষদের গৃহস্থালির কাজে আরও বেশি অংশগ্রহণ করতে হবে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সহযোগিতামূলক আচরণের মনোভাব ও পরিবেশ তৈরি করতে হবে।”
তিনি বলেন, এই প্রকল্প প্রাথমিকভাবে পরিবার ও এলাকার মানুষের মধ্যে মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।
“প্রচলিত সামাজিক প্রথা ভাঙতে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু টেকসই পরিবর্তন আনতে প্রয়াস অব্যাহত রেখেছি।”
নারীর অবমূল্যায়িত গৃহস্থালি কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে নারীপক্ষের শিরিন হক বলেন, “নারীর কাজের মূল্যায়ন কেন দিতে হবে, কত দিতে হবে, কতটা এর মূল্য তা নিয়ে অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ হয়ে গেছে, সেগুলোকে গ্রহণ করে পলিসি তৈরি করা এখনকার দায়িত্ব। যারা পরিকল্পনা কমিশনে আছেন, নীতিনির্ধারক আছেন, তাদের এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে হবে, কীভাবে নারীর এই অবদানকে মূল্যায়ন করা যায়।”